টাঙ্গন নদীর তীরে- (ওএমএস)

'খোলা বাজারে বিক্রয়' বা 'ওপেন মার্কেট সেল' বাংলাদেশ সরকারের সেবামূলক কাজের মধ্যে অন্যতম। বন্যা,মহামারী, মঙ্গা ইত্যাদি কারণে চাল-গমের মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে সরকার বাজারদরের চাইতে কম মূল্যে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করে থাকেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের পক্ষে এ ধরণের কার্যকম চালানোটা সমীচীন নয়। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার গড়ে ওঠেনি। তাই সময় সময় বাজারকে নির্দিষ্ট গতিতে চলতে না দিয়ে সরকার বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের গরীবদের জন্যে এটা কিছুটা সামাজিক নিরাপত্তামূলক উদ্যোগ । সরকারের উদ্দেশ্য মহান শোনালেও এর পিছনে রয়েছে ঘৃণ্য রাজনীতি আর ব্যবসা। যাদের মাধ্যমে কার্যকর করতে হয় তারা ব্যবসায়ী। বাজারে চালের দাম যত সরকার কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা কমদরে বিক্রি করে থাকে। এরজন্যে সর্বপ্রথমে ডিলার নিয়োগ দিতে হয়। ডিলাররা বেশিরভাগ হয় ক্ষমতাসীনদলের অনুসারী মুদি দোকানদার বা ব্যবসায়ী।

ঠাকুরগাঁয়ে একবার ওএমএস চলাকালে বস ছুটিতে থাকায় আমাকে জেলার সব ডিলার নিয়োগ দিতে হয়। ডিলার নিয়োগের কথা শুরু হওয়ার আগেই একদিন এক মোল্লা অফিসে আসল। এসে জিজ্ঞাসা করা শুরু করল কবে থেকে খোলা বাজারে চাল বিক্রয় শুরু হবে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনার কি দরকার? আপনি কি খোলাবাজার থেকে চাল কিনবেন? উনি বললেন না, আমার দোকান আছে, আমি বিক্রি করব। আমি বললাম, খোলা বাজারে সরকার চাল বিক্রয় করে দুস্হ জন গণকে সাহায্য করার জন্যে। এতে ব্যবসায়ীদের তেমন লাভ হয় না, বরন্চ অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আপনার এত উত্সাহ কেন? আর সরকারের তরফ হতে এখনও কোন ঘোষণা আসেনি, আপনারা এত উদগ্রীব হলেন কেন? যারা বাজার দরের কারণে কিনতে পারছে না দাবী উঠার কথা তাদের কাছ থেকে। উনি তখন বললেন, আমাকে মাওলানা রফিক পাঠিয়েছেন। আমি বললাম, উনি কে? মোল্লা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হল, আপনি আমাদের আমীরকে চিনেন না, কতদিন হল ঠাকুরগাঁয় আছেন? আমি বললাম, ওনাকে চিনতে হবে কেন? একটু বাড়িয়ে বললাম, দু'বছর যাবত আছি কখনও নাম শুনিনি। মোল্লার আঁতে ঘা লেগেছে, দু'বছর আছি তাও তাদের আমীরকে চিনি না। আমি শেষে বললাম, দেখেন সরকারী ঘোষণা আসলে নিয়মানুযায়ী আপনাদের জানানো হবে।

যা হোক সরকার একসপ্তাহের মধ্যে ডিলার নিয়োগ দিতে বলল। এত কম সময়ে ডিলার বাছাই ও নিয়োগ দেয়া খুবই চ্যালেন্জিং, এর মধ্যে আমার বিভাগের সচিব, উপরস্হ কর্মকর্তা সবাই ভাবতেছেন আমি সামলাতে পারব কি না? আমার বসও ছুটি বাতিল করে চলে আসতে চাইছেন। আমি সবাইকে বললাম, আগেও আমি ওএমএস এর কাজ করেছি কোন সমস্যা হবে না।

চারদিক থেকে তদ্বির শুরু হল। বিএনপি'র নেতাদের কথা সব ডিলার তাদের দল থেকে দিতে হবে, না হলে সমস্যা হবে। মন্ত্রী মীর্জা সাহেব ফোন করে বললেন, আপনি সাধারণ সম্পাদক সামাউনের সাথে পরামর্শ করেন, ওনার কি বলে শোনেন। আমি মন্ত্রীর বিরোধিতা না করে জ্বী স্যার ,জ্বী স্যার করে গেলাম। সম্পাদক সাহেব তার দলবল নিয়ে বাসায় বসে আছেন। আমাকে ফোন করে বললেন, আপনি আমার বাসায় আসেন? আমি তার আস্পর্ধা দেখে অবাক হলাম। মন্ত্রী সরকারের অংশ, তিনি বাসায় বসতে পারেন, সরকারি কর্মকর্তাকে তলব করতে পারেন , তা বলে সামু? আমি বিগলিত গলায় বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ সামু ভাই ,আমি অফিস ছেড়ে বেরুতে পারব না , বস নেই তাই খুব ঝামেলায় আছি। আপনি যদি কাইন্ডলি আসেন তাহলে আপনার কথা শোনা যাবে।যা হোক শেষ পর্যন্ত ডিলার নিয়োগ দেয়া হল।

জেলা প্রশাসকও ক্ষমতাসীনদের সাথে আপস করে চলেন, কিন্তু আমাকে বললেন, আইন অনুযায়ী চলতে। এদিকে সময়মত চালু করতে না পারলে বদনাম সব আমার এবং বিভাগের হবে। পত্রিকায় নিউজ আসবে, সেটা সামলানো আরও কঠিন।যাহোক ব্যবসায়ী বা রাজনীতিকরা বরাদ্দকৃত চাল নিয়ে দু'এক বস্তা বিক্রি করে গরীব লোকজনকে খেদিয়ে দেয়। বাকি চাল তারা বাজার মূল্যে বিক্রি করে। গরীব মানুষের জন্যে দেয়া সরকারি এ সুবিধা নিতে তাই তাদের এত আগ্রহ। আমরা যতদুর পারি মনিটর করি। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল আর যোগাযোগের অসুবিধার কারণে অনেক জায়গায় গরীব মানুষ সুবিধা বন্চিত হয়। ওএমএস এর সময় ২০-৩০ দিন প্রায় প্রতিদিন চরকীর মত পুরো ঠাকুরগাঁও ঘুরে ঘুরে তদারকি করেছি। অনেক জায়গায় গিয়ে শুনতাম সকালে দু'একঘন্টার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। লোকজন আমাদের কাছে অভিযোগ করত তারা চাল পায়নি।আমি জানতে চাইতাম, এতে তাদের কতটুকু উপকার হয়। তারা বলত, প্রতি কেজিতে ৩ টাকা কম হলে চার কেজির দামে তারা ৫ কেজি কিনতে পারে। অথবা কিছু টাকা বাঁচলে অন্য কিছু কেনার চিন্তা করে। হাড্ডিসার মানুষগুলো বলত, স্যার এত দেরীতে শুরু করলেন ক্যান? আমাদের তো দম আসে আর যায়। আমি বলতাম আপানাদের এলাকার নেতাদের বলেন, কারা প্রতিনিধি তাদের বলেন। তারা না বললে কেউ আসবে না। লোকগুলো চুপ হয়ে যেত, তাদের কথা বলার কেউ নেই। এতকিছুর মাঝেও আমি বলতাম, দম যাবে বুঝেই রোগীর মুখে পানি দেয়া হয়, সরকার তেমনি আপনাদের পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে। তারা বুঝত, রসিকতার জবাবে নির্বিকার, ক্ষুধার্ত পেটে ফ্যাকাসে হাসির চেষ্টা করত।

রাতে বাসায় ফিরে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য,পেয় খাবারের সবটা বিস্বাদ ঠেকত। হাড্ডিসার ছবিগুলো চোখে ভাসত, ভাবতে পারতাম না,রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকরা কিভাবে এদের মুখের খাবার কেড়ে নিচ্ছে।
------
লেখকঃ নাজিম উদদীন
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে বসবাসরত ও উচ্চশিক্ষা গ্রহনরত

কোন মন্তব্য নেই: