টাঙ্গন নদীর তীরে- (প্রটোকল)

প্রটোকল বলতে একেকজন একেকরকম বুঝে থাকেন। আইটি'র লোকজনের কাছে প্রটোকল ডাটা ট্রান্সফারের পদ্ধতি। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রটোকল মানে হল যন্ত্রণা। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের অন্যতম দায়িত্ব হল তার জেলায় যাওয়া সরকারে মন্ত্রী বা বড় অফিসারের সার্বিক সুযোগ সুবিধার প্রতি নজর রাখা যা সংক্ষেপে 'প্রটোকল'।

জেলার সর্বময় কর্তা 'ডেপুটি কমিশনার' বাংলায় বলা হয় 'জেলা প্রশাসক' কিছুটা বাংলা সিনেমার ইংরেজি নামের মত যেমন 'প্রেমের মরা জলে ডুবে না' হয়ে যায়' এ ট্রু লাভ স্টোরি'। উনি প্রশাসনিক দায়িত্বের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও পালন করে থাকেন। তাঁর অধীনে অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া জেলাপর্যায়ে প্রায় ৩-৪ শত কমিটির তিনি প্রধান বা সভাপতি, ফলে তার হয়ে প্রটোকল এবং অন্য অনেক দায়িত্ব সহকারি কমিশনাররা করে থাকেন।

ঠাকুরগাঁয়ে প্রটোকলের কাজ হল যেদিন মন্ত্রী বা সিনিয়র অফিসার আসবেন সেদিন সকাল হতে সৈয়দপুরে গিয়ে বিমানবন্দরে বসে থাকা। অনেকসময় মন্ত্রীমহোদয় নাও আসতে পারেন কিন্তু রিস্ক নেয়া যাবে না। তারপরে সার্বক্ষণিক তার সাথে সাথে থাকা, সরকারি কাজে আসলে তার ব্যবস্হা করা। সাথে বউ ছেলেমেয়ে আনলে তাদের বিনোদনের ব্যবস্হা করা। ভাবীদের প্রটোকলে কোন ভূল হওয়া চলবে ন,এমনও দেখছি সন্ধ্যার সময় ক্লাবে টিটি খেলছি কারও সাথে এমন সময় ডিসি সাহেব বললেন , ভাবী পৌরমিলনায়তনের মেলায় গেছে হায়দার তুমি যাও ভাবীদের প্রটোকল দাও। হায়দার দেখা গেল খেলা ছেড়ে গজরাতে গজরাতে মেলায় যাচ্ছে। মেলায় গিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে ডিসির বউয়ের পেছন পেছন ঘুরছে। বাচ্চারা সমানে বিভিন্ন আবদার করছে আর নাজির কোষাগারের টাকা খরচ করে সব বিল মিটিয়ে যাচ্ছে। ভাবী ঠাকুরগাঁয়ে নতুন আসলে তাকে নিয়ে আম গাছ দেখাতে বালিয়াডাঙ্গী নিয়ে যেতে হবে। বেদানা লিচু, সূর্যপূরী আম খাওয়াতে হবে। এরপর হ্যাড্‌স এবং দর্শনীয় যা আছে তা দেখাতে হবে, এমনকি বাংলাবান্ধা যেতে চাইলে তাও যেতে হবে। দরকার হলে গাড়ী রিকুইজিশান করে।

কোন মন্ত্রী মহোদয় বা রাজপুত্র আসলে কোন কথা নেই । আগে থেকে সব কিছু রেডি থাকতে হবে। এমনকি কোন কোন মন্ত্রী টয়লেটে যাওয়ার আগে ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে টয়লেট চেক করে আসবে সব ঠিক আছে কি না। এরপরে কর্মী সমর্থকের ভীড়ে একসময় মন্ত্রী হয়তো ভূলেই যান একজন থার্ড ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট তার সাথে সারাদিন আছে তার খাওয়া দাওয়া হল কি না।

সবাই একরকম না , তরিকুলের সুনাম শুনেছি, ডেকে এনে পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। যশোরে ডিসিকে সাথে নিয়ে ফুটপাতে বসে চা খায়, ডিসি ইতস্তত করেছে দেখে তাকে গালিও দিয়েছিল। আবার স্বরাস্ট্র সচিব জামাতী ঘরানার ফজলু পরে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শুনেছি অফিসারদের তুই তোকারি করত। এসপিকে ডাকেন, ঐ এসপি'র বাচ্চা এদিকে আয়। উনি আবার মিনারেল ওয়াটার ছাড়া ওজু করতেন না। র‌্যাব নাকি তার ব্রেইন চাইল্ড এজন্য বিএনপির সময় তার খুব দাপট ছিল।

আমারও মাঝে মাঝে প্রটোকল করতে হত। মন্ত্রী/সচিব যদি আমার বিভাগ পরিদর্শন করতে আসেন তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আমাকেও থাকতে হত। এছাড়া উর্ধতন যে কোন কর্মকর্তা ঠাকুরগাঁয়ে আসলে সকাল থেকে রাত ১০-১১ টা পর্যন্ত তার সাথে থাকা বাধ্যতামূলক। তার নাশ্তার মেনু থেকে শুরু করে রাতের বিশ্রাম পর্যন্ত সব ঠিকঠাক রাখার ব্যবস্হা নিতে হবে। আর ডিপার্টমেন্টের সব তথ্য হালনাগাদ করে বগলে ফাইল নিয়ে তার সাথে ঘুরতে হবে। আমার ইমেডিয়েট বস খুব ভয় খেত সব সময় ইয়েস বস। আমি অনেকসময় নিজের মত করে বলতাম। মাঝে মাঝে অফিসার পিঠ চাপড়ানোর ভংগীতে বলত, 'রাইট ইউ আর'। অবশ্য বসের ভয় খাওয়ার কারণ আছে।

একবার উপমন্ত্রী দুলু ঠাকুরগাঁয়ে যুবরাজের সাথে এসেছেন, রাজনৈতিক কাজে। তাই উনি তার সাথে সার্কিট হাউসে গিয়ে দেখা করেননি। পরে দুলু সাহেব ঢাকা গিয়ে সচিবের কাছে কম্প্লেইন করেন। ইমেডিয়েটলি তার সাথে দেখা করতে বলেন। বস পরে নীলফামারী গিয়ে দুলু মন্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে আসেন।

প্রটোকলে অনেকসময় গোপন অনেক ব্যাপার জানা যায়। আমি তখন নতুন , সচিবালয় হতে নতুন অফিসার ঠাকুরগাঁয়ে এসেছেন। তিনি হঠাত গলা নামিয়ে বলা শুরু করলেন তখনকার মন্ত্রী নোমান সাহেব নাকি মন্ত্রণালয় থেকে ৩০০ কোটি টাকা দাবী করেছেন। আমার বস আমাকে ইঙ্গীত দিলেন বাইরে যাওয়ার জন্যে। আমি উঠতেই তিনি বললেন, না ও থাকুক, জানতে হবে না কাদের সাথে কাজ করতে হবে। তো নোমান সাহেব নাকি বলেছেন তিনি চিটাগাংয়ের সবচেয়ে গরীব মন্ত্রী তাই আগামী ইলেকশানের জন্যে তাকে যেন এ টাকাটা দেয়া হয়। আমি তখন জানতাম আমু সাহেব ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালে। সচিবালয়ে অফিসাররা নোমান সাহেবকে বলেছেন, স্যার আপনি সামলাতে পারবেন না, আমু সাহেবের পার্টিতে অনেক ক্ষমতা ছিল। এর কয়দিন পরে ম্যাডাম নোমানকে বদলী করে অন্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দেন। পরে চৌধুরী সাহেব তুলনামূলকভাবে অনেক সত ছিলেন, আওয়ামী লীগের মতিয়া চৌধুরীও সত্ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ঠাকুরাগাঁয়ের মন্ত্রীসাহেব অধ্যাপক ছিলেন তাই ঝামেলা কম করতেন । তিনিও ডিসি অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগে প্রায় ৬০ লাখ টাকার মত নিয়েছেন। পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগেও প্রায় সমপরিমাণ টাকা নিয়েছেন। এসপি এবং ডিসি টাকা কালেক্ট করে দিয়েছে। ক্লাবে অফিসারদের আলাপ থেকে শুনতাম, নিজেরা না পাওয়ার বেদনা থেকে কথাগুলো আমাদের কানে চলে আসত।

প্রটোকল নিয়ে বলতে গিয়ে কোথায় চলে এলাম। প্রটোকল নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, তবে দেশের স্বার্থে এ ধরণের ব্রিটিশ বা সামন্ততান্ত্রিক সিস্টেম যত তাড়াতাড়ি উঠে যায় ততই মঙ্গল।
---------------
লেখকঃ নাজিম উদদীন
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে বসবাসরত ও উচ্চশিক্ষা গ্রহনরত

কোন মন্তব্য নেই: