আমাদের ঠাকুরগাঁও ভ্রমন বৃত্তান্ত...

বাবলু পরিবহন ছাড়ার সময় দেখা গেলো- ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না। সব ঠিকঠাক করে রাত ১১ টার গাড়ী ছাড়লো- ১১.৩৮ মিনিটে। গন্তব্য ঠাকুরগাঁও। ২.০৭ মিনিটে কঠিন জ্যামে পড়লাম- অ্যালেংগাতে।

৩.৩৩ মিনিটে ফুড গার্ডেনে নামলাম আমরা, মোট ১৫ জন। ২/১ জন ছাড়া সবাই রাতের খাবার খেয়ে এসেছি। তবুও সবার জন্য রুটি আর সবজী দিতে বললাম। ১০ মিনিট পর বেয়ারা এসে বললো- সবজী নেই। বাধ্য হয়ে গরুর গোশতের কথা বললাম। গোশতের যা হাল !? ২ পিস গোশত আর ৪ পিস করে হাড্ডি। হাড্ডি পাল্টাতে বললে-এর ফেরত দেয়া হাড্ডি ওকে, ওরটা একে- এভাবে কিছুসময় চললো। বিরক্ত হয়ে কোনো রকমে উঠে পড়লো সবাই। এদিকে গাড়ী ছেড়ে দিচ্ছে। ১২ পিস রুটি, ৩/৪ বাটি গোশত, ১০ টা চা আর ২ লিটারের ১ বোতল পানির দাম গুনতে হয়েছে মাত্র ৪৭৬ টাকা।

ফুড গার্ডেন থেকে ৪.০৩ মিনিটে গাড়ী ছাড়লো। বাসে উঠেই শুরু হলো ফুড গার্ডেন এবং খাবারের আলোচনা, সমালোচনা। অবশেষে সবাই একমত হলো-১.সিরাজগনজে বন্যার কারনে ঘাস নেই, ফলে গরুর শারীরিক অবস্থা ভালো না২.হোটেলের নাম যেহেতু- ফুড গার্ডেন, সেহেতু খাবারের মধ্যে গার্ডেনের ময়লা আবর্জনা তো থাকবেই৩.গোশতের সাথে দেয়া হাড্ডিগুলো- নিশ্চিত “চোষা হাড্ডি”, অন্য কারো খাওয়া...

৪.৪৫ মিনিটে শেরপুর পার হলাম। কী বিশ্রী রাস্তার অবস্থা ! ৬.৫৩ মিনিটে পার হলাম সৈয়দপুর। ৭.৪০ মিনিটে দিনাজপুরের দশমাইল যখন পার হচ্ছি- তখন সবার মধ্যেই অন্যরকোম এক অনুভূতি। এই সেই দশমাইল... ইয়াসমিন...পুলিশ কতৃক ধর্ষণ... পুলিশের গুলি... অনেকগুলো তাজাপ্রাণ...
শুক্রবার সকাল ৮.৩৫ মিনিটে ঠাকুরগাঁও পৌঁছলাম। ১০ টায় নাস্তা সেরে বড় একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য তেঁতুলিয়া। ঠাকুরগাঁও থেকে ৭৫ কিলো।তেতুলিয়ায় নেমে মিষ্টি সমুচা আর চা পান। ঝিরঝির বৃষ্টি। পাশেই মহানন্দা নদী। এপারে বাংলাদেশ, ওপারে ভারত। নদী থেকে পাথর তোলা আর আখ চাষই এখানকার মানুষের প্রধান পেশা।

এবার বাংলাবান্ধা বন্দরের পথে। মাত্র ১৭ কিলো। ঠাকুরগাঁও থেকে ৯২ কিলো, ঢাকা থেকে ৫৩২। ৫/৭ টি ট্রাক, ৬/৭ জন বিডিআর জওয়ান। জিরো পয়েন্টে ছবি তুলে ফের রওয়ানা। আসার পথে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট ঘুরে আসলাম। দৈনিক আজকের কাগজের সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদের চা বাগান। এখানে ছোট ছোট কিছু বাংলো আর ডরমেটরি আছে। ঢাকা থেকে বুকিং দিয়ে গেলে আপনি থাকতে ফারবেন। এখানকার অতিথিদের জন্য দুটো নিয়ম আছে। ১. এটি ধূমপান মুক্ত এলাকা ২. এখানে আগত অতিথিদের জন্য নো মাছ, নো মাংশ। শুধুই সবজী। আমরা ২০০৫ সালে ‘সূর্য উতসব’ করেছিলাম এখানে।

বিকেল ৪ টা নাগাদ ফিরে আসলাম ঠাকুরগাঁও। এসে এক বিয়েতে (আমাদের এক বন্ধুর বন্ধু) খাবার দাবার সেরে আবার দে ছুট।
এবারের গন্তব্য- দিনাজপুরের কান্তজীউ’র (এটিই সঠিক বানান) মন্দির। যার স্থানীয় নাম কান্তনগর মন্দির।
এটি নির্মাণ করেন- দিনাজপুরের জমিদার মহারাজা প্রাণনাথ ও তাঁর পোষ্যপুত্র রামনাথ। সময় লেগেছে ৪৮ বছর (১৭০৪ থেকে ১৭৫২)। এটি ৩ তলা বিশিষ্ট, ৫০ ফুট বর্গাকৃতির। ইট দিয়ে বানানো। এ মন্দিরের সারা গায়ে অসাধারণ শিল্পকর্ম আছে। যার মধ্যে উদ্ভিদ, প্রাণীকূল, জ্যামিতিক নকশা, রামায়ণ ও পৌরাণিক দৃশ্যাবলী এবং সে আমলের সামাজিক ও অবসর বিনোদনের দৃশ্যাবলী। ১৯৬০ সালে কান্তজীউ’র মন্দিরকে ততকালীন সরকার কতৃক সংরতি প্রাচীনকীর্তি হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ১৭৫২ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত এটি ছিলো ৫ গম্বুজ বিশিষ্ট। বর্তমানে একটি গম্বুজও নেই। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে গম্বুজগুলো ভেংগে যায়। কান্তজীউ’র মন্দির দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে। আমাদের মাইক্রো ঠাকুরগাঁয়ের পথে ছুটে। রাত ৮.৩০ নাগাদ মূসা ইব্রাহীমের বাসায় পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নেই সবাই। রাতের খাবার সেরে আবার দৌড়াই বাস স্টেশন। এবার বাবলু নয়, হানিফ এন্টারপ্রাইজ। সবাই ভয়ানক কান্ত। বাস ছুটছে, ঢাকার পথে। আমার মনে হয়, ক- তো- দি- ন (আসলে মাত্র একদিন) আমার ছেলে আর তার মাকে দেখিনা...

মেসবাহ য়াযাদ @সামহোয়্যারইন

ঠাকুরগাঁ , আমার ছোট্ট শহর, আমার শৈশব

ঠাকুরগাঁ , আমার ছোট্ট প্রিয় শহর। বাংলাদেশের ম্যাপের এককোনায় লুকিয়ে থাকা ছিমছাম ছোট্ট একটি শহর।

বাবার ছিলো বদলির চাকুরি।
একবার সবাইকে পাঠিয়ে দিলেন ঠাকুরগাঁয়। ৩ রুমের ছোট্ট একটি টিনের বাসায় থাকতাম সবাই মিলে। আম্মু , আমরা ৩ ভাই বোন, প্রায় সমবয়সী ছোট দুই চাচা, এক ফুফু আর আমার গ্রেট "কাকা"।
কাকার ছিলো বিশাল এক মটরবাইক। পুরো শহরে কাকার মতো এতো বড় মটরবাইক আর কারো ছিলো না। সেটা নিয়ে আমারো ছিলো অনেক গর্ব।

বাসার টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে শান্তির ঘুমের কথা এখনো ভুলতে পারি না।

বাসার সামনে সামনে বিশাল এক মাঠ। বিকেলে সবাই মিলে টেনিস বল দিয়ে বোমবাস্টিং বা সাত চাড়া খেলা। মাঝে মাঝে একটু আধটু মারামারি !!

গুড্ডি ওড়ানোর কথা বলতেই হয়। সারাটা দিন ধরে সুতায় মান্জা দেয়া। (মানজা দেবার কতো যে তরিকা ছিলো !!) গুড্ডি কাটা কাটির মহাযুদ্ধ (আসলেই মহাযুদ্ধ), ভোকাট্টা গুড্ডির পেছনে পাগলের মতো ছুটে বেড়ানো, একটা গুড্ডি পেলে বীরের মতো সবাইকে দেখানো, আবার নিজের গুড্ডি কাটা গেলে কাঁদা । কি দারুন দিন ছিল সব।

সাইকেল চালানো শিখেছিলাম সেখানে। বয়স কতোই বা তখন। এই ৫ কি ৬। সাইকেলের সিটে বসতে পারতাম না। হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালিয়ে সারা শহর ঘুরে-বেড়ানো। আহ, দারুন দিন ছিলো সেসব।

সে সময় ঠাকুরগাঁয় পড়তাম ফুলকুড়ি নামে ছোট্ট একটি কিন্ডারগার্ডেনে । টুকটুকে হলুদ রঙের ইউনির্ফম। হেডমিসট্রেসের নামটা মনে নেই, উনার মেয়ের সাথে ছিলো আমার হাড্ডা হাড্ডি লড়াই। সেটা মাঠে নয়, পড়াশোনায়। ও হতো প্রথম আর আমি দ্বিতীয়। আমার আর প্রথম হওয়া হলো না সেখানে।

শুক্রবারে যে মসজিদে মিলাদ হতো সেই মসজিদে দল বেঁধে ছুটে যেতাম। কোথায় নামাজ, চোখ ও মন পরে থাকতো তবারকের দিকে। মিলাদ শেষ হতেই তবারক নিয়ে হুড়োহুড়ি।

দুজন স্যারের কাছে পড়েছিলাম সসময়। জন্মদিনে জীবন স্যারের দেয়া ঝিনুকের গিফটের কথা ভুলতে পারি না। অসীম স্যারের কাছে পড়েছিলাম কিছুদিন। স্যারের প্রিয় বাই সাইকেলের প্রতি ছিলো দারুন লোভ। চুরি করে কতো যে চালিয়াছি ! স্যার পরে কলকাতা চলে যান। অশোক স্যার ছিলেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্যের ছোট ভাই।

একবার বাড়ী থেকে পালিয়াছিলাম। অনেককেই দেখতাম বাড়ী হতে পালাতে, আর আমি পালাবো না !! সে কি হয় ? আম্মু একবার দুষ্টুমির জন্য মার লাগালেন। আর আমি সেই মার খেয়ে বাসার পেছন দেয়াল দিয়ে সোজা পালালাম। এক্কেবারে গ্রামের বাড়ী। পড়নে ছিলো হাফ প্যান্ট ও সাদা স্যান্ডো গেনজি। গ্রামের বাড়ী যেতেই দাদা পুকুরে জাল ফেল্লেন, পালানোর পুরষ্কার । গরম গরম মাছের ভাজা। বিকেলে কাকা আমাকে ঠাকুরগাঁ নিয়ে আসলেন। তখন আম্মুর কি আদর। এখনো ভুলিনি।

সেই ছোট্ট শহর আর সেই ছোট্ট নেই। ছোট থেকে বড় হয়েছে। নতুন নতুন বাড়ী হয়েছে, কাঁচা রাস্তা হয়েছে পাকা । লোক জন বেড়েছে। তবে প্রিয় শহর প্রিয়ই রয়ে গিয়েছে। বয়স বেড়েছে , পুরোনো বন্ধুরা পুরোনোই রয়ে গিয়েছে। এখনো সবাই এক সংগে দেখা হলে সেই আগের বয়সে ফীরে চলে যাই।

মাঝে মাঝে মনে হয় টাইম ট্রাভেল করে যদি ফীরে চলে যাওয়া যেতো শৈশবের সেই সব দিনগুলোতে।
কোথায় গেলো সেই সব দিন !

টাংগণ নদীর তীরে

এক.
আমি যখন শহরে পৌঁছাই তখন ভোর হয় হয়, প্রদোষকালীন অন্ধকার।
ছোট জেলাশহর, একটাই বলতে গেলে বড় রাস্তা। রাস্তার পাশে খোলা রেস্তোরায় না ঘুমানো লোকজনের ক্লান্ত চেহারা। বেশীর ভাগ খদ্দের দুরপাল্লার ট্রাক ড্রাইভার। রাজধানী হতে নৈশ পরিবহন আসায় আপাত শান্ত আবহাওয়া কিছুটা চঞ্চল হয়। মাত্র ঘুম থেকে উঠে আসা রিকশাচালকদের কিছুটা সজীব এবং ধ্যানী চেহারা।

আমি কাউকে জানিয়ে আসিনি, ফলে গন্তব্য জানা থাকলেও আপাতত কোথাও বিশ্রাম নিয়ে কিছুটা ভদ্রস্হ হয়ে নিতে হবে। এছাড়া এরকম সময়ে কাউকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, আজীবন লেট রাইজার আমার নীতিবিরুদ্ধ। তাই বাস থেকে নেমে ফুটপাতে দাড়িয়ে আয়েশ করে চা আর সিগারেট শেষ করলাম। পাশের সিটের যাত্রী আরেক শহরে যাবেন, তিনি আমাকে দু একটি হোটেলের নাম বলে বিদায় নিলেন।

ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে এখানটায়। আসার আগে পত্রিকায় দেখলাম তাপমাত্রা দশের নীচে। এ শহরে আবহাওয়া অফিস না থাকায় সঠিক তাপমাত্রা কোনপত্রিকাই বলতে পারেনি। রাস্তার উপরে কিছুলোক আগুন পোহাচ্ছে। আমি গিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলাম ২-৩ ঘন্টার জন্যে কোথায় ওঠা যায়। তাদের মধ্যে একজন আমাকে নিয়ে এল শহরের এক বোর্ডিং বা হোটেলে। সেখানে মালপত্র রেখে ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে নাশতা করতে বের হলাম।

এরমধ্যে আকাশ অনেক ফরশা হয়ে গেছে। বয়স্ক লোকজন, ঝাড়ুদার,স্বাস্হ্য উদ্ধারকারীর দল রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। সাড়ে নয়টার দিকে গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম। জেলা শহরের চাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেছে। সর্বত্র রিকশার জট। সরকারী অফিসে তখনও কাজ ঠিকমত শুরু হয়নি।

কপাল রিকশাওয়ালা আমার মত নতুন জায়গা চিনে না।যা হোক শেষ পর্যন্ত অফিস বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। শীতের সকাল, ব্যস্ততা নেই। ঢুকার মুখে একজন দেখলাম রোদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আমার কাছে জানতে চাইল কাকে চাই। আমি বললাম, অফিসের বসের সাথে দেখা করতে চাই। কেন? কারণ আজ আমার চাকরীর প্রথমদিন। আমি বসের সহকারী কর্মকর্তা। সাথে সাথে সিগারেট ফেলে দিয়ে, স্যার আসেন, বসেন, আমি বুঝতে পারিনি, আই অ্যাম সরি। আমি স্যার অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বড় স্যার তো এখনও আসেননি। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন।ততক্ষণে অফিসে সাড়া পড়ে গেছে। কেরাণীমহল হতে একে একে এসে সবাই পরিচয় দিতে লাগল, আমি অফিস সহকারী, আমি হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইউ ডি এ, কারিগরী পরিদর্শক ইত্যাদি। ইতিমধ্যে বস্‌ চলে এসেছেন। আমার জয়েনিংয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আমার পিওন নির্দিষ্ট করে দেয়া হল। আমার আগে একজন চলতি দায়িত্বে ছিলেন, তার কাছ থেকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে ঐ দিন পূর্বাহ্নে বিসিএস (ফুড) এর Assistant Controller of Food পদে চাকরিতে যোগদান করলাম।

দুই.

প্রথম দিনেই বসের সাথে যাই রুহিয়া খাদ্যগুদাম পরিদর্শনে। এটি ৫০০০ টন ধারণ ক্ষমতার এল.এস.ডি বা Local Storage Depot। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে অফিসে বসান। আমি ডিসি ফুডের সাথে ঘুরে ঘুরে গুদামে সংরক্ষিত খাদ্যশস্য দেখি। গুদামে সাধারণত স্ট্যাক বা খামালজাত করে ধান,চাল,গম সংরক্ষণ করা হয়। এ খামাল ঘনক আকৃতির১৪-১৫ সতরে সাজানো হয়। সবকিছু্ ম্যানুয়াল,ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক দিয়ে করানো হয়। তখন ডিসেম্বর মাস, আমন মৌসুম চলছে। সরকার কম দাম দেয়ায় কেনা কম হয়েছে, শুধু ডেসপাচ্‌ হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে।

ঠাকুরগাঁওয়ে মোট বারটি এল.এস.ডি, ধারণক্ষমতা প্রায় ৬০০০০ টন। সদর,শিবগন্জ,ভুল্লী,রুহিয়া,গড়েয়াহাট হল ষডর থানায়।পীরগন্জ ,রাণীশংকৈল,নেকমরদ,বালিয়াডাংগী,লাহিড়ীহাট,যাদুরানী,হরিপুর । আমার পড়াশোনা শুরু হয়ে গেল। আমি ছিলাম ডিসি ফুডের স্টাফ অফিসার। অর্থাৎ সব ফাইল আমার হয়ে যাবে এবং আমি উনার হয়ে ফাইল অনুমোদন করতে পারব। বস বেজায় খুশী আমি আসায়। পিয়নদের ঢেকে বলল এখন থেকে এসি সাহেব সব সত্যায়িত করবে।আমার এখানে যাতে কেউ না আসে।

বন্ধুরা সব কল করতে লাগল। অনেকে ভাবতে পারেনি আমি এককথায় একেবারে ডীপ নর্থে চলে যাব। যারা আমার মত চাকরীতে জয়েন করেছে তারা সবাই ফোন করে খবর নেয়া শুরু করল। ঠাকুরগাঁওয়ে কামালের পদায়ন হয়েছে সহকারী কমিশনার কাম ৩য় শ্রেনীর হাকিম হিসেবে। ও খুব মনোক্ষুণ্ণ ঠাকুরগাঁয় আসায়। বলে আয়োডিনের ঘাটতি এলাকা, কোথায় এসে যে পড়লাম। আমি বললাম, তাইত রাস্তায় কুকুর দেখছি হর্ন দিলেও সরে না।মানুষও সরতে দেরী করে। গাড়ীর ড্রাইভার অবশ্য অভ্যস্ত।

থাকার ব্যবস্হা হয়েছে কম্পাউন্ডের ভিতরে। আপাতত বসের বাসায় দু একদিন থাকতে হবে। সহকারী কমিশনাররা সব সার্কিট হাউজে আছে, পরে ব্যাচেলর কোয়ার্টারে যাবে। আমার ইচ্ছা ছিল ওদের সাথে থাকা। আমাদের যেহেতু অফিসের উপরে ব্যাচেলর অফিসারদের জন্যে ব্যবস্হা আছে তাই বস চাচ্ছেন না আমি সার্কিট হাউজ বা অন্য কোথাও উঠি।

বিকেলে দেখতে গেলাম টাংগন নদী। নদীর অপমান, ঝোরা বললেই কাছাকাছি যায়, বড়জোর খাল বলা যায়। এ নদীর দুপাড়ে পুরো শহর মাঝে সংযোগ সেতু। একধারে বাণিজ্যিক অন্যধারে প্রশাসনিক কাজকর্ম চলে। শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরাস্তা। শহরের মধ্য দিয়েই জেলার অন্যান্য স্হানের যোগাযোগ। আর চৌরাস্তা সবসময় সরগরম। বিখ্যাত গাউছিয়া আর সুরুচি রেস্তরাঁ এ চৌরাস্তাতেই। পাশেই কোর্ট,ডিসি অফিস, এরপরে জেলখানা।

ঐদিন বর্তমান কারান্তরীণ, যুবরাজ আসার কথা শীতবস্ত্র বিতরণের জন্যে। দেখলাম মাইকিং হচ্ছে , যাদের কাপড় আছে তাদের দেয়া হবে না। এই শীতেও অনেকে কাপড় খুলে ঘুরছে নতুন কাপড়ের আশায়।

সন্ধ্যায় বড়মাঠের পাশে অফিসার্স ক্লাবে গেলাম, সেখানে গিয়ে বন্ধু কামাল এবং নতুন অফিসারদের দেখলাম। পরিচয় হলাম,ডিসি, এডিসি,এসপি,জেলার,জজ, সিনিয়র সহকারী জজ,অনুষ্ঠান সংগঠক ঠাকুরগাও মোটামুটি উপস্হিত সবার সাথে। সবাই সন্ত্রস্ত যুবরাজ এলাকায়। ক্লাবে টেনিস,টিটি,ব্যাডমিন্টন,তাস,ক্যারম খেলার ব্যবস্হা আছে। এছাড়া আছে টেলিভিশন। একতলা বাড়ি, দোতলার কাজ চলছে। ভবিষ্যতে ভাবীরা মানে আমলার স্ত্রীরাও আসবেন। খুব ভাল উদ্যোগ। বেচারারা সারাদিন একা থাকে। সন্ধ্যার পরেও চলে আসতে হয় ক্লাবে। আমার মনে পড়ল কবির আর্তনাদ-
প্রভূ আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রীআমাদের রক্ষা কর...

তিন.

একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। ঠাকুরগাঁওয়ে মোটর সাইকেলের খুব ছড়াছড়ি। ইয়াং জেনারেশানের কাছে মোটর সাইকেল হল স্ট্যাটাস সিম্বল। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে মাস্ট। জেলা সদরের সাথে অন্য উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্হা তেমন ভাল না, ১-২ ঘন্টা পরপর বাস সার্ভিস। ফলে নিজস্ব পরিবহন থাকাটা স্বচ্ছল মধ্যবিৎতের বিলাসিতা না হয়ে , হয়ে দাঁড়ায় প্রয়োজন। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করে। এটা আমার কাছে কিছুটা নতুন মনে হয়েছে।

একদা মালদহ জেলার অংশ ঠাকুরগাঁয় সামাজিক দৃষ্টিভংগী অনেক উদার। সাংস্কৃতিকভাবে অনেক উন্নত, ঘরে ঘরে সংগীতের চর্চা। শতকরা ৪০ ভাগের উপরে অধিবাসী হিন্দু এবং আদিবাসী, ফলে বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল অপেক্ষা এখানের সামাজিক ব্যাপারগুলো অন্যরকম। যেমন বলা যেতে পারে, এখানে বড় দুটি হোটেলে গরুর মাংস পাওয়া যায় না।

কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য,অভিনেতা লিটু আনাম এরা ঠাকুরগাঁয়ের। এছাড়া ভারতের বিখ্যাত শিল্পী পংকজ উদাসের জন্ম ঠাকুরগাঁয়। নিরিবিলি শহরের মাঝে সংস্কৃতি সাধনার একাট নীরব স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।

আমি কাজ শুরু করার কিছুদিন পরে আমার বস বলল সংগীত চর্চা শুরু করতে। এখানে যখন এসেছ, কিছু সাথে নিয়ে যাও। এছাড়া ব্যাচেলর মানুষ সময়টা ভাল কাটবে। ওস্তাদ ঠিক করা আছে, উনি যে ওস্তাদের কাছে শিখেন আমিও তার কাছ থেকে গান শিখতে পারব। উনি গত ৫-৬ বছর যাবত সকাল সন্ধ্যা রেওয়াজ করে আসছেন। আমি একটা বোকার মত কাজ করলাম, যদিও জানি, বস ইজ অলওয়েজ রাইট । আমি বললাম, শুনতে পছন্দ করি, তাই বলে গান গাওয়া আমার দ্বারা হবে না। এ বড় সাধনার ব্যাপার। উনি বললেন, হারমনিয়াম পছন্দ কর না, গীটার,বেহালা যেটা ইচ্ছা শিখতে পার। আমি বেশী আগ্রহ দেখাইনি। বস চুপ করে গেলেন,ওস্তাদ প্রৌঢ় রবিদাও তেমন প্রসন্ন হলেন বলে মনে হল না।

গান শেখার ব্যাপারে আরেকজন বলেছিল, সে আমাদের সমবয়সী। গানের টিউশনী করে বেড়ায়, অফিসারদের সাংস্কৃতিক কাজে কর্মে সাহায্য করে। তার ইচ্ছে ছিল, গান শেখানোর সাথে সাথে ছুটির দিনে বা সন্ধ্যায় আমার ব্যাচেলর কোয়ার্টারে তার কোন ছাত্রী বা গানের সমঝদার কাউকে নিয়ে আসবে আরাম আয়েশের জন্য। কেউ কিছু বলতে পারবে না। গানের অজুহাতে চলবে দেহতত্বের গভীর গোপন রহস্যের অনুসন্ধান। অফিসাররা তাকে পছন্দ করে, অনেক অফিসারের বাসায় তার অবাধ যাতায়াত। আমাকে শুধু তবলা আর হারমনিয়াম কিনতে হবে। আমি সকাল-সন্ধ্যা সরগম সাধতে হবে এটা ভাবলে কোন প্রলোভন কাজ করত না।

সংগীত যে হত না তা নয়। নতুন এএসপি'র সাথে খুব খাতির হয়ে গেল। সংস্কৃতিসেবী সে ছেলেটি দেখলাম তার বশংবদ হয়ে গেছে। ক্লাবে বা ছুটির দিনে সবসময় তাদেরএকসাথে দেখা যায়। এ এস পি বুয়েটের ছাত্র ছিল, তার বন্ধুরা সব বাইরে। সে এখন একেবারে খাঁটি পুলিশ, এককালে হয়ত অন্যরকম ছিল। সদ্য ট্রেনিং শেষ করে এসেছে। কনস্টেবলদের আনা গাঁজায় দম দিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইতে পারে,আর পুরনো হিন্দী গান খুব খোলে তার গলায়। মাঝে মধ্যে আমার বাসায় অথবা বিভিন্ন শিল্পীদের বাসায় ঘরোয়া আসরে সে গান গাইত। মাঝে মধ্যে ভাব উঠলে লালনের গান গইতাম, কিন্তু আমার বাসায় অন্য কোথাও না।

নীচে কেয়ারটেকার,নাইটগার্ড হয়ত ভাবত স্যারদের কি হয়েছে। মাঝে মাঝে কাজের ছুতা করে দোতলায় দেখতে আসত। হয়ত তারা এসব দেখে অভ্যস্ত। সবারই একটু আধটু নেশার অভ্যাস আছে।

নেশার জিনিস ঠাকুরগাঁয় অবাধে পাওয়া যায়। হেরোইন, এল এস ডি, কোকেন,কোডেন, ফেন্সিডিল, গাঁজা,ভাং,চড়স,হাসিস কি নাই। একদিন রাতের বেলায় সরকারী শূঁড়িখানায় গেলাম, এ এসপিকে সাথে নিয়ে। সাদা ড্রেসে, সাথে সংস্কৃতিসেবক। দেখলাম শুধু কেরু পাওয়া যায়, তাও খোলা ড্রামে। আমরা ভয় পেয়ে চলে এলাম, নরসিংদী ট্রাজেডীর কথা মনে পড়ল। যেকোন সময় যেকোন জেলায় আবার তা ঘটতে পারে। গাঁজা পাওয়া যেত ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছ থেকে। মাদক অধিদপ্তরের সাথে পুলিশ রেইড দিয়ে প্রায়ই কেজি কেজি গাঁজা পোড়াত তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের পূজায়। পালের গোদা ধরার আগ্রহ কখনও দেখিনি। ওখান থেকে সামান্য একটু প্রসাদ পেলেই আমাদের মচ্ছব হয়ে যেত।

নেশা নিয়ে একদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমি ক্লাব থেকে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে রাত এগারটা বেজে গেছে। এসে দেখি, নতুন এক নাইট গার্ড। মান্থলী শিফ্ট শেষে আগের জন দিনের ডিউটিতে ফেরত গেছে। তো এ ব্যাটা মাল খেয়ে একেবারে টাল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে,আমাকে চিনতে পেরে জড়িয়ে জড়িয়ে সালাম দিল। এখন বাসার নীচের গেটের চাবি তার কাছে থাকার কথা। সে চাবি হারিয়ে বসে আছে, নড়ার ক্ষমতা নাই। কোথায় হারিয়েছে বলতে পারে না। কম্পাউন্ডের মাঠে হারিকেন টর্চ দিয়ে খুঁজছে। আমি বসকে ফোন করে ঘটনা জানালাম, উনি শুনে হাসতে হাসতে শেষ। বললেন ওর একটু অভ্যাস আছে। তুমি কড়া করে ঝাড়ি দাও। বল যে তাকে শোকজ করা হবে। আচ্ছা করে ঝাড়ি কসালাম। নীতিগতভাবে আমি কিছু বলতে পারি না, কিন্তু এখন ডিউটিরত অবস্হায় সে মদ খেলেও মাতাল হতে পারে না। যাই হোক মাঠে চাবি খুঁজে পাওয়া গেলে মাতালের পাল্লা থেকে বাঁচলাম। পরদিন এসে তার কান্নাকাটি,মাফ চাওয়া ইত্যাদি। বস কিছু বলছে না। অন্য স্টাফরা দেখলাম ঘটনা দেখছে। দু একজন এসে বলল, স্যার ও এমনিতে ভাল মানুষ , এবারের জন্যে মাফ করে দেন। আমিও প্রথমবারের মত বলে, ভবিষ্যতের ব্যপারে সাবধান করে দিলাম
ক্রমশ.....
____________________
লেখক : নাজিম উদ্দীন , যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী, প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা।
নাজিম উদ্দীনের ব্লগ @সামহোয়্যারইন

নীল গাইয়ের সন্ধানে !!

আচ্ছা কেউ কি জানেন 'নীল গাইয়ের সন্ধানে ' গল্পটি কে লিখেছে, কোথায় পাওয়া যাবে? ছোটবেলায় ছয়নিকা বা সেরকম কোথাও পড়েছিলাম। গল্পটা ঠাকুরগাঁও, রাণীশংকৈল এলাকা নিয়ে ।ঐ অঞ্চলে একসময় নীল গাই পাওয়া যেত। লেখক ঢাকা থেকে নীল গাইয়ের খোঁজে ঠাকুরগাঁও গিয়েছিলেন। তখন ভাল রাস্তা ছিল না। যতদুর মনে পড়ে লেখক হ্যারিংবোন সড়কে খোলা জীপে ধুলি ধুসরিত হয়ে এস ডি ও'র বাংলোয় পৌঁছেছেন।
অনেকদিন ধরে খুঁজছি, কারো জানা থাকলে আওয়াজ দিবেন.....।
_____________
লেখক : নাজিম উদ্দীন , যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী, প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা।
নাজিম উদ্দীনের ব্লগ @সামহোয়্যারইন